আজ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব প্রবারণা পূর্ণিমা। ‘প্রবারণা’ শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে আগত। ‘প্রবারণা’ শব্দটির পালি ভাষারূপ ‘পবারণা’। এর অর্থ হলো ‘নিষেধ করা’, ‘শিক্ষা সমাপ্তি’, ‘অভিলাষ পূরণ’, ‘আশার তৃপ্তি’, ‘প্রকৃষ্টরূপে বরণ করা’, ‘দোষত্রুটি স্বীকার’ ইত্যাদি। ব্যাপক অর্থে প্রবারণা বলতে অসত্য ও অকুশল কর্মকে বর্জন করে সত্য ও কুশল কর্মকে বরণ করা। প্রবারণা পূর্ণিমার অপর নাম ‘আশ্বিনী পূর্ণিমা’।
প্রবারণা পূর্ণিমা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বর্ষাব্রত পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও এই পূর্ণিমা তিথি সব বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর কাছে তাৎপর্যপূর্ণ। বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত এই তিন মাস বর্ষাব্রত পালন করেন। এই তিন মাস তাঁরা বিহারে অবস্থান করেন। যেহেতু একসঙ্গে বসবাস করতে গেলে পরস্পরের মধ্যে ভুলভ্রান্তি হওয়া স্বাভাবিক, সেহেতু ভিক্ষুদের মধ্যেও ভুলভ্রান্তি হতে পারে। তাই বর্ষাব্রত পালন শেষে ভিক্ষুগণ আশ্বিনী পূর্ণিমা তিথিতে প্রবারণা করেন।
অর্থাৎ এই দিনে ভিক্ষুগণ পরস্পরের কাছে তাঁদের পূর্বকৃত ভুলভ্রান্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন, যার মাধ্যমে বুদ্ধের শাসনের উৎকর্ষ সাধিত হয় এবং ভিক্ষুসংঘের কল্যাণ সাধিত হয়। ভিক্ষুসংঘের বর্ষাবাস পরিসমাপ্তির এই পবিত্র দিনকে কেন্দ্র করেই প্রবারণা পূর্ণিমা পালন করা হয়। প্রবারণা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য একটি আবশ্যক বিধিবদ্ধ নিয়ম। শ্রাবস্তীর জেতবনে একসময় ভগবান বুদ্ধ অবস্থান করছিলেন।
সেই সময় বিপুলসংখ্যক প্রগাঢ় মিত্রভাবাপন্ন ভিক্ষু কোশল রাজ্যের এক আবাসে বর্ষাবাসে রত ছিলেন। ভিক্ষুগণ শঙ্কিত ছিলেন এই ভেবে যে যদি তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে কথা বলেন, তাহলে হয়তো তাঁদের ধ্যান-সাধনার পথে বাধার সৃষ্টি হবে। এ জন্য কেউ কারো সঙ্গে কোনো প্রকার বাক্যবিনিময় না করেই মৌনভাবে বর্ষাবাস পালন করেন। পরবর্তী সময়ে বর্ষাবাস সমাপ্ত হলে মহামানব গৌতম বুদ্ধ ভিক্ষুগণের কাছে তাঁদের বর্ষাবাস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন এবং প্রত্যুত্তরে ভিক্ষুগণ বললেন,
তাঁরা নিজেদের মধ্যে কোনোরূপ কথা না বলে মৌনভাবে বর্ষাবাস অতিক্রান্ত করেছেন। ভিক্ষুগণের এমন উত্তরে বুদ্ধ অসন্তুষ্ট হন। কারণ একসঙ্গে বসবাস করতে গেলে নিজেদের মধ্যে ভুলত্রুটি কিংবা মতানৈক্য হওয়া স্বাভাবিক। তাই বলে ভিক্ষুগণ মৌনব্রত পালন করতে পারেন না। বুদ্ধ ভিক্ষুদের আদেশ প্রদান করলেন, ‘হে ভিক্ষুগণ, আমি অনুজ্ঞা প্রদান করছি
—বর্ষাবাসিক ভিক্ষুগণ দৃষ্ট, শ্রুত অথবা আশঙ্কিত ত্রুটি বিষয়ে প্রবারণা করবে।’ বুদ্ধ প্রবারণাকে ভিক্ষুদের জন্য পরস্পরের মধ্যে সংঘটিত অপরাধ থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায় এবং অবশ্য পালনীয় নিয়ম হিসেবে নির্দেশ করেছেন। বুদ্ধের এই আদেশ থেকে প্রবারণার মাহাত্ম্য অনুধাবন করা যায়। একে অন্যের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে যে অনন্য দৃষ্টান্ত প্রবারণা পূর্ণিমা শিক্ষা দেয়, তা শুধু ভিক্ষুসংঘের জন্য নয়,
বরং সব মানবজাতির জন্য অনুকরণীয়। কারণ এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে সম্প্রীতির শিক্ষা। প্রবারণা পূর্ণিমার পরদিন থেকে পরবর্তী এক মাস অর্থাৎ কার্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত কঠিন চীবর দান সম্পন্ন হয়ে থাকে। বর্ষাবাস সমাপ্তকারী ভিক্ষুগণ কঠিন চীবর গ্রহণ করেন। প্রবারণা পূর্ণিমার পবিত্র দিনে বৌদ্ধ উপাসক-উপাসিকাগণ পরিষ্কার পোশাকে বৌদ্ধ বিহারে সমবেত হয়ে বুদ্ধপূজা করেন, ভিক্ষুদের আহার্য দান করেন,
পঞ্চশীল, অষ্টশীল গ্রহণ করেন এবং বিকেলে ধর্মীয় সভার আয়োজন করা হয়। প্রবারণা পূর্ণিমার এই পবিত্র দিনের আকর্ষণীয় একটি দিক হলো সন্ধ্যায় ফানুস ওড়ানোর উৎসব। সর্বস্তরের মানুষ ফানুস ওড়ানো উপভোগ করে। ফানুস মূলত ওড়ানো হয় বুদ্ধের কেশ ধাতুর প্রতি পূজা ও সম্মান প্রদর্শনার্থে। কথিত আছে, গৌতম বুদ্ধ গৃহ ত্যাগ করার পর ভাবলেন, তাঁর কেশরাশি প্রব্রজিতের পক্ষে অন্তরায়।
তাই তিনি কেশকলাপ কেটে রাজমুকুটসহ ঊর্ধ্বাকাশে নিক্ষেপ করেছিলেন। তাবতিংশ স্বর্গের দেবগণ তাঁর কেশরাশি নিয়ে চুলমনি চৈত্য প্রতিষ্ঠা করে পূজা করতে লাগলেন। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই সশ্রদ্ধচিত্তে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা প্রবারণা পূর্ণিমায় ফানুস উড়িয়ে থাকেন।
এই দিনে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরা ঘরে ঘরে ভালো রান্নার আয়োজন করেন। সর্বোপরি ধর্মীয় আচরণবিধি অনুসরণ করে একটি উৎসবমুখর পরিবেশে প্রবারণা পূর্ণিমা উদযাপিত হয়। প্রবারণা পূর্ণিমা আমাদের শিক্ষা দেয় ক্ষমাশীলতা, শ্রদ্ধাবোধ, পরস্পরের প্রতি হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমেই কল্যাণের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।